আমরা জানি ধনাত্মক আধানের প্রোটন এবং আধান নিরপেক্ষ নিউট্রন নিয়ে পরমাণুর কেন্দ্রীণ বা নিউক্লিয়াস গঠিত। মূলত পরমানুর প্রায় সব ভরই এর কেন্দ্রীণে পুঞ্জিভুত থাকে। মৌল ভেদে পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রোটন ও নিউট্রনের সংখ্যা ভিন্ন হয় । যেহেতু মৌলের ভরসংখ্যা হল প্রোটন ও নিউট্রনের সমষ্টি তাই যতবেশি প্রোটন, নিউট্রন উপস্থিত থাকে মৌলও তত ভারী হয় ।হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস কেবল ১ টি প্রোটন, হাইড্রোজেনের আইসোটোপ ডিউটেরিয়াম ১টি প্রোটন ও ১ টি নিউট্রন, হিলিয়ামের কেন্দ্রীণ ২ টি প্রোটন ও ২ টি নিউট্রন আবার কার্বনের কেন্দ্রীণ ৬ টি করে প্রোটন ও নিউট্রন নিয়ে গঠিত।তাই , এদের মধ্যে কার্বন সবচাইতে ভারী, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভারী মৌল হল হিলিয়াম। সাধারনত প্রোটনের সংখা অনুসারে পরমাণুর কেন্দ্রে প্রোটনের সংখ্যাকে পারমানবিক সংখ্যা বলে। আধান নিরপেক্ষ পরমাণুতে ইলেকট্রন-এর সংখ্যাও পারমাণবিক সংখ্যার সমান। পারমাণবিক সংখ্যা অনন্যভাবে একটি মৌলিক পদার্থকে চিহ্নিত করে। নিউক্লিয়াসের ধনাত্মক চার্জের সংখ্যা এবং পারমাণবিক সংখ্যার সমান থাকে। প্রোটনের ভর ও নিউট্রনের ভর প্রায় সমান বলে তাদের সমষ্টি অর্থাৎ পরমাণুর ভর সংখ্যাকেই পারমাণবিক ভর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমরা জানি, বিভিন্ন মৌলিক পদার্থকে একত্রে উপস্থাপনের আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত ছক পর্যায় সারণী পিরিয়ডিক টেবিলকে (Periodic Table) সাজানো হয়েছে পারমানবিক সংখার ক্রমান্বয় অনুসারে । সবচাইতে কম পারমানবিক সংখ্যার মৌল হাইড্রোজেন আর ২০১৬ সাল অবধি আপডেটেট পর্যায় সারনি অনুসারে অগানেসন(Oganesson) হল ঠাি পাওয়া সবচাইতে বেশি পারমানবিক সংখ্যার মউল(১১৮) । কিন্তু , কল্পিত আরেকটি মৌল আছে যার পারমাণবিক সংখ্যা শূন্য ! এটি কেবল নিউট্রনের সহযোগে গঠিত , যাকে বলা হয় নিউট্রোনিয়াম(Ne utronium) । ১৯২৬ সালে বন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর আন্দ্রেস ভন আন্ত্রোপফ নিউট্রন আবিস্কারের আগেই এই কল্পিত মৌলটিকে তার পর্যায় সারণীতে স্থান দেন । সেই সময়ে নিউট্রোয়াম থাকার সম্ভাবনা নিয়ে সংশয় থাকলেও । ধারনা করা হয় নিউট্রন তারার উপাদানই হল নিউট্রোনিয়াম ! নিউট্রন তারা একটি সুবৃহৎ তারার অবশিষ্টাংশ যা সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় তারার বিবর্তনের অনেকগুলো সম্ভাব্য পরিণতির মধ্যে একটি হল এই নিউট্রন তারা। একটি সাধারণ নিউট্রন তারার ভর সাধারণত সূর্যের ভরের ১.৩৫ থেকে ২.১ গুণ হয়ে থাকে। এর ব্যাসার্ধ্য ২০ থেকে ১০ কিলোমিটারের মত হয় যা সূর্যের ব্যাসার্ধ্যের তুলনায় ৩০,০০০ থেকে ৭০,০০০ গুণ কম। এ কারণে এদের ঘনত্ব খুবই বেশী। এর ঘনত্ব প্রায় ৮×১০১৩ থেকে ২×১০১৫ গ্রাম প্রতি ঘনসেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়। ঘনত্বের এই মান পরমাণুর কেন্দ্রীয় ঘনত্বের প্রায় সমান।এখন কথা হল কেন এখানের বস্তুর ওজন অস্বাভাবিক বেশী?এর উত্তর পাওয়া যাবে পরমানুর গঠনের মধ্যে।একটি পরমাণুর প্রায় সব ভরই থাকে তার নিউক্লিয়াসে।কারন একটি পরমাণুর যা ভর তা হল তার প্রোটন আর নিউট্রনের মোট ভর।এখানে ইলেকট্রনের ভর তাদের মোট ভরের তুলনায় এত কম যে তা ধরার দরকার পরে না।আর এই পুরো ভরটুকুই থাকে পরমাণুর নিউক্লিয়াসে।কিন ্তু দেখুন একটি পরমাণুর ব্যাস যেখানে ১০^-৮মিঃ সেখানে নিউক্লিয়াসের ব্যাস মাত্র ১০^-১৫মিঃ।তাহলে বুঝতে ই পারছেন পরমাণুর প্রায় পুরো জায়গাটাই ফাকা।এখন যদি পরমাণুর মধ্যে কোন ফাকা না থাকত তাহলে তার ভর প্রায় এক কোটি গুন বেড়ে যেত। কিন্তু নিউট্রন স্টার আসলে আরও বেশি ঘন।কেননা এখানে পরমাণুর মত ফাকা জায়গা তো নেই ই বরং পুরো নিউট্রন একটি আর একটির সাথে লেগে আছে ঠাসা ভাবে।পরমাণুর নিউক্লিয়াসেও নিউট্রন আর প্রোটনের মধ্যে কিছুটা ফাকা ছিল, কিন্তু এখানে তাও নেই।তাছাড়া অনুসমুহ যখন বস্তু গঠন করে তখন প্রচুর পরিমানে আন্তঃআনবিক ফাকা স্থান থাকে।আর নিউট্রন স্টার এ তো পরমানুই নেই।তাই আমাদের চেনা জগতের বস্তুর তুলনায় নিউট্রন স্টার এত বেশি ঘন।এত বেশি ঘন যে, যার এক চামচ পরিমান পদার্থের ভর দশ কোটি টন ! ১৯২৮ সালে চার্লস জ্যানেট , ১৯৪৪ সালে এমারসন, ২০০৫ সালে ফিলিপ স্টুয়ার্ট তাদের নিজস্ব সারণীতে নিউট্রোনিয়ামকে স্থান দেন ! বিভিন্ন সাইন্স ফিকশনে নিউট্রোনিয়াম বেশ জনপ্রিয় । নিউট্রোনিয়ামের পদার্থকে উচ্চ ঘনত্বের মৌল হিসেবে বিবেচনা করা হয় ! নিউট্রন তারা যেমন উচ্চ ঘনত্বের , একিভাবে নিউট্রোনিয়ামের পদার্থেরও । মজার কথা হল নিউট্রন তারা উচ্চ ঘনত্বের হলেও কিন্তু সলিড স্টেট বা কঠিন অবস্থায় থাকে না । বরং নিউট্রন তারা তরলের মত আচরন করে । একি ভাবে নিউট্রোনিয়ামও তরলের মত আচরন করে ! তবে সমস্যা হল বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে আবার নিউট্রন প্রোটনে/ইলেকট্রনে পরিনত হতে পারে ! যখন কোন পরমাণুর নিউক্লিয়াস থেকে ইলেকট্রন বা পজিট্রন নির্গত হয় তখন তাকে বিটা ক্ষয় (β Decay) বলে। বিটা ক্ষয় দুই প্রকারঃ β– ক্ষয় বা ইলেক্ট্রনের (e–) নির্গমন এবং β+ ক্ষয় বা পজিট্রন (e) নির্গমন। দুর্বল নিউক্লীয় বলের কারণে সাধারণত বিটা ক্ষয় হয়ে থাকে। β– ক্ষয়ে ইলেকট্রন, প্রোটন ও অ্যান্টিনিউট্রিনো এবং β+ ক্ষয়ে পজিট্রন,অ্যান্ট ি প্রোটন ও নিউট্রিনো নির্গত হয় । এক অর্থে সহজ ভাবে বলতে নিউট্রন হল ইলেকট্রন ও প্রোটনের সমষ্টি । অর্থাৎ β– ক্ষয়ে ইলেকট্রন ও প্রোটন উৎপন্ন হয় । নিউট্রন তারকা গঠনের সময় এর বিপরীত কার্য অর্থাৎ ইলেকট্রন,প্রোটন মিলে নিউট্রন গঠন করে , এই প্রক্রিয়ায় হল নিউট্রন বিটা ক্ষয় ! এই প্রক্রিয়ায় শক্তির নিত্যতা সুত্র মেনে চলে । একিভাবে মোট চার্জের পরিমানও অটুট থাকে ! বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে নিউট্রন থেকে ইলেকট্রন- প্রোটন রূপান্তর সম্পর্কে বুঝতে হবে আমাদের কোয়ার্ক(Quark) পর্যায়ে যেতে হবে। আমরা জানি ২টি আপ কোয়ার্ক (u) ও ১টি ডাউন কোয়ার্ক (d) নিয়ে একটা প্রোটন (uud) তৈরি হয়; এবং ১টি আপ কোয়ার্ক (u) ও ২টি ডাউন কোয়ার্ক (d) মিলে একটা নিউট্রন (udd) গঠিত হয়। একটা শর্ত মেনে কোয়ার্ক গুলো একটি থেকে অন্যটিতে পরিবর্তিত হতে পারে। শর্তটি হলো যখন এক কোয়ার্ক (আপ/ডাউন) অন্য কোয়ার্কে (ডাউন/আপ) রূপান্তর ঘটবে তখন সাথে বাড়তি একটা W± বোসন তৈরি হবে। এখন বাকিটা নিচের সমীকরণ থেকে বুঝে নেই; u → d + W± অথবা d → u + W± এখন প্রোটন-নিউট্রন কাহিনী গেল, কিন্তু W± বোসনের পরিনতি কি? অথবা ইলেকট্রন বা পজিট্রন কোথা থেকে নির্গত হবে! আসলে বিটা ক্ষয়ের অন্যতম নিয়ামক হচ্ছে W± বোসন – এটিই পরবর্তিতে ইলেকট্রন বা পজিট্রন হয়ে নির্গত হয়ে যায়। তবে এর সাথে একটা নিউট্রিনো বা এন্টিনিউট্রিনো উৎপন্ন হয়, যেটা সাধারণত দেখানো হয়না কিন্তু W± বোসন থেকে ইলেকট্রন বা পজিট্রন তৈরি হওয়ার সময় যথাক্রমে ১টা ইলেকট্রন এন্টিনিউট্রিনো অথবা ইলেকট্রন নিউট্রিনো উৎপন্ন হওয়া আবশ্যিক। নিচের সমীকরন দেখি – β– ক্ষয়ের ক্ষেত্রে, W– → e– + v‾e অথবা, β+ ক্ষয়ের ক্ষেত্রে W+ → e + ve উল্লেখ্য, W± বোসন হল এক ধরনের অতি পারমানবিক কণা যা দুর্বল নিউক্লীয় বলের জন্য দায়ী এবং এরা নিজেরাই নিজেদের অ্যান্টিপার্টিকেল ! আর এই প্রক্রিয়ার আমরা দেখলাম যে নিউট্রন থেকে কিভাবে ইলেকট্রন ও প্রোটন উৎপন্ন হয় । নিউট্রন যে ইলেকট্রন ও প্রোটনের সমষ্টি মূলত তা বোঝানোর সুবিধার জন্য আমরা এই ক্রিয়া টাকে বিপরীত ভাবে ব্যাখ্যা করেছি । কাজেই এখন নিউট্রোনিয়ামের গঠনের ক্রিয়া নিয়ে আর সংশয় থাকবে না বলে আশা করছি। একটু ভাবলে বুঝবেন নিউট্রিন তারার অভ্যন্তরে অসম্ভব চাপের জন্য নিউট্রনের বিটা ক্ষয় হয় না । তবে সাধারন চাওএ বিটা ক্ষয়ও সাধারন ব্যাপার । তাই নিউট্রোনিয়ামও সাধারন চাপে থাকতে পারবে না ! নিউট্রোনিয়ামকে শুধু কল্পিত মৌল বলেই বিবেচনা করা হয় না । বরং এর কল্পিত আইসোটোপও রয়েছে । যেমনঃ মোনোনিউট্রন, ডাইনিউট্রন, ট্রাইনিউট্রন,টেট্রানিউট্রন.... ..।