ইসলামে কিছু বিলুপ্ত হওয়া সুন্নাত বা বিশুদ্ধ ইসলামী আমল রয়েছে, যা অনেক মুসলিম সমাজে বর্তমানে প্রায় পালন করা হয় না, যদিও এগুলি ইসলামের আদর্শ ও সুন্নাতের অংশ। বিভিন্ন কারণে, যেমন মানুষের অজ্ঞতা, আমলের প্রতি উদাসীনতা বা সমাজের পরিবর্তনশীল চিন্তাভাবনা, এই সুন্নাতগুলো প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে এগুলোর মধ্যে কিছু সুন্নাত এখনও পালনযোগ্য এবং ইসলামে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে। নিচে কিছু বিলুপ্ত হওয়া সুন্নাত উল্লেখ করা হলো:
১. সকালে ও সন্ধ্যায় তাসবীহ (জিকির):
বিশুদ্ধ সুন্নাত: মহানবী (সা.) সকালে ও সন্ধ্যায় কিছু নির্দিষ্ট তাসবীহ বা জিকির পাঠ করতেন, যেমন:
আল্লাহু আকবর ৩৩ বার,
সুবহান আল্লাহ ৩৩ বার,
আলহামদুলিল্লাহ ৩৩ বার।
বর্তমান অবস্থা: অনেক মুসলিম আজকাল এই সুন্নাত ভুলে গেছেন বা কম পালন করেন, অথচ এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত ছিল। মহানবী (সা.) বলেন, "যে ব্যক্তি সকালে এই জিকির পড়বে, তার সমস্ত গুনাহ মাফ করা হবে।" (বুখারি)
২. হাদীসের ‘হালকাহ’ (পাঠ শ্রেণী):
বিশুদ্ধ সুন্নাত: মহানবী (সা.) সাধারণত হাদীসের পাঠ শ্রেণী আয়োজন করতেন, যেখানে তার সাহাবীরা এসে হাদীস শোনার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করতেন। এই সুন্নাতটি এখন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে, কারণ আজকাল অনেকেই হাদীস বা ইসলামী জ্ঞান ইন্টারনেট ও অন্যান্য মাধ্যম থেকে গ্রহণ করেন।
বর্তমান অবস্থা: মুসলিম সমাজে একে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় না, অথচ এটি ছিল ইসলামিক শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
৩. আল্লাহর পথে সাধ্যমতো দান করা (সাদাকাহ):
বিশুদ্ধ সুন্নাত: মহানবী (সা.) তার জীবনে প্রতিদিন সাদাকাহ দান করতেন, এমনকি তিনি বলতেন, "হয়তো একটি সাদাকাহ তোমাকে জান্নাতে প্রবেশের পথ দেখাবে।"
বর্তমান অবস্থা: অনেকেই এখন সাদাকাহ দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন বা দানের মাত্রা কমিয়ে দিয়েছেন। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত, যা বর্তমানে অনেকেই অভ্যস্ত হননি।
৪. মুখে মিষ্টি স্বাদ নেওয়া ও মিসওয়াক ব্যবহার করা:
বিশুদ্ধ সুন্নাত: মহানবী (সা.) মিসওয়াক ব্যবহার করতেন এবং এর মাধ্যমে দাঁত পরিষ্কার করতেন। এটি ছিল সুন্নাত এবং তিনি বলেন, "মিসওয়াক মুখের পরিষ্কারক এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উপায়।" (বুখারি)
বর্তমান অবস্থা: আজকাল অনেক মুসলিম মিসওয়াক ব্যবহারের বদলে টুথব্রাশ ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হয়েছেন, এবং মিসওয়াক প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
৫. রোজার পূর্বে সাহরী খাওয়া:
বিশুদ্ধ সুন্নাত: রোজা রাখার আগে সাহরী খাওয়া একটি সুন্নাত। মহানবী (সা.) বলেন, "সাহরী খাও, কারণ এতে বরকত রয়েছে।" (বুখারি)
বর্তমান অবস্থা: অনেক মুসলিম সাহরী খাওয়ার বদলে রোজা শুরু করার পূর্বে কিছু খাওয়া বাদ দিয়ে থাকেন, যার ফলে এই সুন্নাতটি অনেকাংশে হারিয়ে গেছে।
৬. ঘুমানোর আগে আয়ে আছর (কুরআন তিলাওয়াত):
বিশুদ্ধ সুন্নাত: মহানবী (সা.) ঘুমানোর আগে কিছু কুরআন তিলাওয়াত করতেন, বিশেষত সূরা মুলক ও সূরা ওয়াকি'আহ পাঠ করতেন। তিনি বলেছিলেন, "সূরা মুলক ঘুমানোর পূর্বে পাঠ করলে আল্লাহ তাকে কবরে বিপদ থেকে রক্ষা করবেন।"
বর্তমান অবস্থা: আজকাল এই সুন্নাত তেমনভাবে পালিত হয় না এবং মুসলিমরা ঘুমানোর আগে সাধারণত কুরআন তিলাওয়াত করেন না।
৭. দাওয়াতের সময় তাওয়াক্কুল:
বিশুদ্ধ সুন্নাত: মহানবী (সা.) দাওয়াত দেওয়ার পর সবকিছু আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল (বিশ্বাস) করতেন এবং বলতেন, "যে কাজের জন্য আল্লাহর সাহায্য প্রয়োজন, তা তারই সাহায্য দ্বারা হতে হবে।"
বর্তমান অবস্থা: অনেক মুসলিম এখন দাওয়াতের ব্যাপারে কেবলমাত্র নিজেদের চেষ্টাকে গুরুত্ব দেন, তাওয়াক্কুলের মুলনীতি থেকে অনেকটাই বিচ্যুত হয়েছেন।
৮. প্রতি ওয়াক্ত নামাজের পর সালাম দেয়া:
বিশুদ্ধ সুন্নাত: প্রতিটি ওয়াক্ত নামাজের পর "আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ" বলার আগে আরো কিছু দু'আ পড়া ছিল সুন্নাত, যেমন "আস্তাগফিরুল্লাহ"। এটি ছিল মহানবী (সা.)-এর প্রথা।
বর্তমান অবস্থা: অনেক মুসলিম নামাজ শেষে শুধুমাত্র সালাম দেন, তবে ঐ সুন্নাতটি অনেকে অনুধাবন করেন না।
৯. মাসালার পর দাঁড়িয়ে দোয়া করা:
বিশুদ্ধ সুন্নাত: নামাজের শেষে কিছু সময় দাঁড়িয়ে দোয়া করা ছিল সুন্নাত। মহানবী (সা.) প্রার্থনায় দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন, যা আজকাল অনেক মুসলিম পালন করেন না।
১০. মহিলাদের জন্য ঈদের দিন জামা বদলানো:
বিশুদ্ধ সুন্নাত: ঈদের দিন মহিলারা তাদের পুরানো জামা বদলিয়ে নতুন জামা পরতেন। এটি একটি সুন্নাত, যা বর্তমানে অনেক মুসলিম পালন করেন না।
---
এই সুন্নাতগুলো ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল, কিন্তু অনেক কারণে এগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যদি মুসলিম সমাজ এই সুন্নাতগুলোকে পুনরায় জীবনে প্রতিস্থাপন করতে পারে, তবে তারা ইসলামের পূর্ণতা ও সঠিক পথ অনুসরণ করতে সাহায্য পাবে।